ঠাকুরগাঁও থেকে: ঠাকুরগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত হল ওরাঁও, সাঁওতাল সহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নানা সম্প্রদায়ের কারাম উৎসব। পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য ও নিজেদের সুস্থতায় কারাম নামের একটি বিশেষ বৃক্ষের বন্দনার মধ্য দিয়ে এসব সম্প্রদায়ের লোকজন এই উৎসব পালন করে।
সোমবার রাতে সদর উপজেলার সালন্দর ইউনিয়নের পাঁচপীরডাঙ্গা গ্রামে শুরু হয় এ উৎসব। পর দিন মঙ্গলবার কারাম গাছের পূজাঅর্চনা শেষে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এই উৎসবের সমাপ্তি হয়। দিনের বেলা উপোষ এবং উপোষ ভাঙ্গার পর নাচ, গান ও পূজা অর্চনার মধ্য দিয়ে দুই দিনব্যাপী চলে এ উৎসব। বর্ষায় খাল-বিল, নদী-নালায় পূর্ণতা আসে। গাঢ় সবুজ রং নিয়ে প্রকৃতিতে আসে তারুণ্য। খাল-বিলে ফোঁটে শাপলা-শালুক। ধান লাগানোর পর আদিবাসী সম্প্রদায়ের অফুরন্ত অবসর। ঠিক সেই ভাদ্র মাসে আসে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকেদের অন্যতম বার্ষিক উৎসব ‘কারাম’।
প্রতিবছর ভাদ্রের শেষে এবং আশ্বিনের শুরুতে ওরাঁও জনগোষ্ঠী এই উৎসব আয়োজন করে । ওরাঁওদের হিসেবে ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে এই উৎসব পালিত হয়। উৎসবে গাছ দেবতা যেন সামনের বছরে ভালো ফসল দেন সে প্রার্থনা করা হয়। এই গাছকে ঘিরে চলে আরাধনার গান। সব বয়সের আদিবাসী শিশু হতে কিশোর বৃদ্ধা যুবক-যুবতীরা সবাই এই গানের সুরে সুর মিলিয়ে গাছ দেবতার প্রার্থনায় মেতে উঠে। গাছ দেবতার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ধান, সর্ষেদানা, কালাই, গম নানা ফসলের বীজ এই কারাম গাছের গোড়ায় রাখা হয়। যেন গাছ দেবতা সামনের বছর ভাল ফলন দেন সে প্রার্থনা করে রাতভর চলে এই সম্প্রদায়ের নৃত্যগীত ও হাড়িয়া পান।
স্থানীয়রা জানান, কারাম উৎসব উদ্যাপনের জন্য আদিবাসী নর-নারী সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পূজার প্রথম দিন উপোস থাকে। সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় বিশেষ খাবার। সৃষ্টিকর্তার প্রতি উৎসর্গ করার পর সেগুলো আমন্ত্রিত অতিথি ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সারা দিন আদিবাসী মেয়েদের উপোসের মধ্য দিয়ে কারাম পূজা শুরু হয়। পরে তারা মাদল, ঢোল, করতাল ও ঝুমরির বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে এলাকার গাছ থেকে কারামগাছের (খিল কদম) ডাল তুলে আনে। এরপর তারা একটি পূজার বেদি নির্মাণ করে। সূর্যের আলো পশ্চিমে হেলে গেলে সেই কারামগাছের ডালটি পূজার বেদিতে রোপণ করা হয়। আদিবাসী পুরোহিত উৎসবের আলোকে ধর্মীয় কাহিনী শোনান। সে সঙ্গে চলে কাহিনীর অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যা শেষ হলে বেদির চারধারে ঘুরে ঘুরে যুবক-যুবতীরা নাচতে থাকে। এদিকে পুরোহিতের ধর্মীয় কাহিনী পাঠ শেষ হওয়ার পর উপোস রাখা মেয়েরা পরস্পরকে খাবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙে। এরপরই আপ্যায়ন করা হয় আমন্ত্রিত অতিথি ও আত্মীয়স্বজনকে। ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে স্থানীয় নদীতে কারাম ডালটি বিসর্জনের মাধ্যমে কারাম উৎসব আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়।
ঠাকুরগাঁও জেলা আদিবাসী পরিষদের সভাপতি জাকোব খালকো বলেন, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, বড়াইক, কুর্মি, সিং, পাহান, মাহালিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের নিজ নিজ রীতিতে কারাম পূজা পালন করে থাকে। কারাম নামের গাছের ডাল কেটে বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা মান্য করে এই উৎসব করা হয় বলে এর নাম কারাম উৎসব।